অপরাধ - দূর্নীতি

কোটাভঙ্গ, পদোন্নতি বাণিজ্য ও নথি গোপন —রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলে ভয়াবহ অনিয়মের চিত্র

  মোঃ সাকিবুল ইসলাম স্বাধীন ২ ডিসেম্বর ২০২৫ , ৬:৩৭:৩৫ প্রিন্ট সংস্করণ

নিজস্ব প্রতিবেদন: বাংলাদেশ রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে নানামুখী অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে তপোময় বিশ্বাস নামের এক কর্মকর্তাকে কেন্দ্র করে উদ্ঘাটিত তথ্য পুরো পশ্চিমাঞ্চলের দুর্নীতির ভয়াবহ বাস্তবতাকে আরও স্পষ্ট করেছে। কোটাভঙ্গ, অবৈধ পদোন্নতি, দায়িত্ব প্রদান, রাজনৈতিক তদবির, অভ্যন্তরীণ লেনদেন, নথি গোপন—সবকিছু মিলিয়ে রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের প্রশাসনিক কাঠামোতে চরম অস্বচ্ছতা বিরাজ করছে। আরও উদ্বেগজনক বিষয় হলো—পশ্চিমাঞ্চলের কর্মকর্তারা নিজেদের অনিয়ম ও অসঙ্গতি রেলভবনের মহাপরিচালকের (DG) ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। এতে রেলওয়ে ব্যবস্থার সামগ্রিক দুর্নীতির চিত্র আরও ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে।

রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের দুর্নীতি শুধু তপোময় বিশ্বাসের ঘটনায় সীমাবদ্ধ নয়। দীর্ঘদিন ধরে এই অঞ্চলে দুর্নীতি যেন পদ্ধতিগতভাবে চালু রয়েছে। বিগত সময়ে আওয়ামী লীগপন্থী ঠিকাদার ও নেতাকর্মীদের বিশেষ সুবিধা দেওয়া হলেও ৫ আগস্টের পর হঠাৎ পরিস্থিতি বদলে গিয়ে এখন বিএনপি–জামায়াতপন্থীদের সঙ্গেও একইভাবে ঘনিষ্ঠতা তৈরি করে সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। টেন্ডার সিন্ডিকেট, কেনাকাটায় অনিয়ম, প্রাপ্য দরদাতাকে কাজ না দিয়ে কমিশন চুক্তির ভিত্তিতে পছন্দের ব্যক্তিকে কাজ পাইয়ে দেওয়া, জাল সনদ ব্যবহার করে চাকরি গ্রহণ, জুলাইয়ের ঘটনায় দায়ের মামলার আসামিদের মোটা অর্থের বিনিময়ে বদলি ও চাকরিতে বহাল রাখা, পদোন্নতি বাণিজ্য, হাজিরা খাতায় অনুপস্থিত কর্মচারীদের উপস্থিত দেখানো—এসব অভিযোগ পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়েতে দীর্ঘদিন ধরেই স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে।

দুদক বিভিন্ন সময়ে অভিযান চালিয়ে বহু অনিয়মের প্রমাণ পেলেও দুর্নীতির এ পাহাড় কমার বদলে আরও বেড়েছে। বিশেষ করে গত ৫ আগস্টের পর এসব অনিয়ম নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

কোটাভিত্তিক চারজনের জায়গায় অর্থের বিনিময়ে অযোগ্য হয়েও পঞ্চম ব্যক্তি তপোময় বিশ্বাসের চেয়ার দখল অভিযোগের অনুসন্ধানে প্রায় এক মাস আগে প্রতিবেদক তপোময় বিশ্বাসের বর্তমান দায়িত্ব—সহকারী সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক (Assistant Controller of Stores)—সম্পর্কে তথ্য জানতে বাংলাদেশ রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলে তথ্য অধিকার (RTI) আবেদন দাখিল করেন। কিন্তু প্রথমবার রেলওয়ে আবেদনটি তুচ্ছ ভুল দেখিয়ে গ্রহণই করেনি। পুনরায় আবেদন করার পর দীর্ঘ অপেক্ষার পর যে জবাব দেওয়া হয়, তা বরং আরও অস্পষ্টতা ও সন্দেহ তৈরি করেছে।

রেলভবনের দপ্তরাদেশ অনুযায়ী—৮ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখে উপপরিচালক (পার্সোনেল-১) পলাশ কুমার সাহা স্বাক্ষরিত এক নির্দেশে সরঞ্জাম বিভাগের পুনরায় আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত বদলি ও পদায়ন দেওয়া হয় তপোময় বিশ্বাস, ঊর্ধ্বতন উপসহকারী প্রকৌশলী (কেলোকা), পার্বতীপুর থেকে সহকারী সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক (রাজশাহী)—চলতি দায়িত্বে (চ.দা.) নিয়োজিত। কিন্তু বাস্তবে তাঁর রাজশাহী অফিসের সাইনবোর্ডে কোথাও “চলতি দায়িত্ব” শব্দটি নেই, যা স্পষ্ট স্থায়ী কর্মকর্তার মতোই অবস্থান করানো হয়েছে।

পশ্চিমাঞ্চলের জবাবে আরও বলা হয়—SSAE/S (১০ম গ্রেড) এবং Assistant Controller of Stores—ACOS (৯ম গ্রেড) পদে পদোন্নতি ও বদলি শুধুমাত্র রেলভবন, ঢাকার মহাপরিচালকের কার্যালয় থেকে হয়ে থাকে। তপোময় বিশ্বাস পূর্বে SSAE/S ছিলেন, পরে তাঁকে “চলতি দায়িত্বে” ACOS করা হয়েছে। কিন্তু এর কোনো নথি—DPC মিটিং, সুপারিশ, চিঠি—পশ্চিমাঞ্চল দপ্তরের কাছে নেই। এতে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠে: যদি পদোন্নতি ঢাকায় হয়ে থাকে, তবে সংশ্লিষ্ট নথি পশ্চিমাঞ্চলে পাঠানো হয়নি কেন? কোটাভিত্তিক চারজনের সুযোগে পঞ্চম ব্যক্তি তপোময় বিশ্বাস কীভাবে সুযোগ পেলেন? চলতি দায়িত্বের মেয়াদ, শর্ত, অনুমোদন—এসব কোথায়?

তথ্য প্রদান কর্মকর্তা ও সহকারী মহাব্যবস্থাপক (AGM পশ্চিম) মেহেদী হাসান জানান—RTI আবেদনটিতে কোথাও SSAE, কোথাও ACOS লিখে নাকি ভুল করা হয়েছে; তাই দপ্তর বিষয়টি বুঝতে পারেনি। কিন্তু আবেদনপত্রে স্পষ্টভাবে Assistant Controller of Stores পদ, তপোময় বিশ্বাসের নাম এবং স্টোরস ডিভিশনের সুনির্দিষ্ট তথ্য উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও “ভুল কোর্ড” অজুহাত দেখানো কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

RTI আইন ৬(২) অনুযায়ী—অফিস কোনো বিষয় না বুঝলে ১০ দিনের মধ্যে আবেদনকারীকে স্পষ্ট করতে বলা বাধ্যতামূলক। কিন্তু তারা তা করেনি; বরং ২৭ দিন পর অস্পষ্টতার অজুহাত দেখায়—যা RTI আইনবিরোধী।

AGM আরও বলে—তিনি RTI বিষয়ে একাধিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, কাউকে তথ্য না দিয়ে ফেরান না। তপোময় বিশ্বাস নাকি বর্তমানে পার্বতীপুরে “ঊর্ধ্বতন উপসহকারী প্রকৌশলী” হিসেবে আছেন, পদোন্নতি দেওয়া হয়নি যেকোনো সময় সেখানেই নয়তো অন্য জায়গাই প্রেরণ করতে পারে, তিনি রাজশাহীতে শুধু চলতি দায়িত্বে আছেন। এই জন্য পদোন্নতি বিষয়ে নথি নেই। আপনি এখানে আপিল সহ রেলভবনে আবেদন শুধু হয়রানি আর সময় নষ্ট হবে বলে পরামর্শ দেন। কিন্তু পার্বতীপুরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে—তপোময় বিশ্বাস অনেক আগেই প্রমোশন পেয়ে রাজশাহীতে যোগ দিয়েছেন। স্থানীয় কর্মকর্তারাও বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

চিফ পার্সোনেল অফিসার (পশ্চিম)-এর পক্ষে জবাব প্রদানকারী জুনিয়র পার্সোনেল অফিসার–১ (পশ্চিম) মো. মিজানুর রহমানের তথ্য ও AGM-এর বক্তব্য অনুযায়ী—তপোময় বিশ্বাস নাকি “চলতি দায়িত্বে” ACOS পদে কাজ করছেন। কিন্তু রাজশাহী দপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা এবং পার্বতীপুরের সূত্রগুলো বলছে—তাঁকে বাস্তবে প্রমোশন দিয়ে ৯ম গ্রেডের দায়িত্বে বসানো হয়েছে। অর্থাৎ অফিসিয়াল বক্তব্য ও মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা বিপরীতমুখী।

সরকারি চাকরি নীতিমালা অনুযায়ী চলতি দায়িত্ব সাধারণত ৬ মাসের বেশি দেওয়া যায় না এবং এটি স্থায়ী দায়িত্বের বিকল্প নয়। চলতি দায়িত্বে বসালে সাইনবোর্ডে “চ.দা.” উল্লেখ বাধ্যতামূলক। কিন্তু তপোময় বিশ্বাসের সাইনবোর্ডে এর কোনো উল্লেখ নেই—যা নিয়ম লঙ্ঘনের স্পষ্ট উদাহরণ।

সবচেয়ে বড় প্রশ্ন—যদি তিনি সত্যিই চলতি দায়িত্বে থাকেন, তাহলে তিন বছর ধরে একই পদে কীভাবে বহাল আছেন? আর যদি দায়িত্বপ্রাপ্তির নথি পশ্চিমাঞ্চলে না থাকে, তবে প্রশাসনিকভাবে এটি অস্বাভাবিক এবং আইনবিরোধী। সবমিলিয়ে স্পষ্ট—এখানে সরকারি নিয়ম–নীতির গুরুতর ব্যত্যয়, দায়িত্বপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে আইনি লঙ্ঘন, অভ্যন্তরীণ প্রভাব–ক্ষমতার ব্যবহার, এবং তথ্য গোপনের মাধ্যমে সম্ভাব্য দুর্নীতির চিত্র রয়েছে। বিষয়টি ঘিরে একাধিক রহস্য তৈরি হয়েছে, যা স্বাধীন তদন্ত ছাড়া নিরসন সম্ভব নয়।

পশ্চিমাঞ্চলের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা (পরিচয় অপ্রকাশের শর্তে) জানিয়েছেন—মোটা অঙ্কের অর্থ লেনদেনে কোটা লঙ্ঘন করে তাঁকে তিন বছর ধরে রাখা হয়েছে; “চলতি দায়িত্ব” কেবলমাত্র বাহ্যিক অজুহাত। স্টোরস বিভাগে যেসব অনিয়ম ও অপচয় দীর্ঘদিন ধরে চলছে—এসবের সুবিধাভোগীদের একজন হিসেবে তাঁকে রেখে দেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। এমনকি RTI আবেদন জমা দেওয়ার পর উচ্চপদস্থ কয়েকজন নাকি “জরুরি মিটিং” করে কীভাবে তথ্য এড়ানো যায় তা নিয়েও আলোচনা করেছেন; সেই বৈঠকে তপোময় বিশ্বাসকে বিষয়টা “ম্যানেজ করার” নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে অভ্যন্তরীণ সূত্র দাবি করেছে।

এই বিষয়ে জানতে সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক (পশ্চিম) মো. আনোয়ারুল ইসলাম এবং মহাব্যবস্থাপক (পশ্চিম) ফরিদ আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা বলেন—তপোময় বিশ্বাস চলতি দায়িত্বে আছেন; এ দায়িত্ব দিয়েছেন রেলভবনের মহাপরিচালক (DG)। বিষয়টি DG-ই ভালো জানেন।

কিন্তু তাদের এই বক্তব্য নতুন করে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে: তারা কি নিজেদের দায় চাপা দিতে ডিজিকে সামনে ঠেলে দিচ্ছেন, নাকি সত্যিই DG নিয়ম ভেঙে পদোন্নতি দিয়েছেন—যা গোপনের লক্ষে নথি পশ্চিম দপ্তরে পাঠানো হয়নি?

তবে এসব প্রশ্নের ভিড়ে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতা সামনে আসে—রাজশাহীর জেলা প্রশাসনের ও দুদকের কিছু দায়িত্বশীল কর্মকর্তা এবং রাজশাহী, পাকসি ও পার্বতীপুর রেলওয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, মহাপরিচালক মো. আফজাল হোসেন একজন সৎ, নীতিবান ও দায়িত্বশীল কর্মকর্তা হিসেবে দীর্ঘদিন ধরেই খ্যাত। দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি বহু অভিযোগ তদন্ত করে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিয়েছেন। দেশের বিভিন্ন রেল দপ্তরে তাঁর অজান্তে বহু অনিয়ম ঘটে থাকতে পারে—যা একজন মহাপরিচালকের জন্য সবসময় নজরদারি করা বাস্তবসম্মত নয়। তাদের মতে—নিজেদের দায় আড়াল করতে এবং বিষয়টিকে ভিন্ন দিকে ঘোরাতে ইচ্ছাকৃতভাবে ডিজির ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করা হয়েছে।

রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের এই অন্ধকার অধ্যায়ের ভেতরের সত্য উন্মোচন আজ সময়ের দাবি। রেল মন্ত্রণালয়ের সঠিক হস্তক্ষেপ ও স্বচ্ছ তদন্তই পারে এই ধোঁয়াশার আসল চেহারা তুলে ধরতে। রাজশাহীর আপিলের জবাব এবং ঢাকায় ডাকযোগে পাঠানো আবেদনের তথ্য হাতে এলেই—এই অনুসন্ধানের দ্বিতীয় পর্ব সকালের বুলেটিনে প্রকাশিত হবে।

আরও খবর

Sponsered content