অপরাধ - দূর্নীতি

রাজশাহীর গোদাগাড়ী খাদ্য গুদামে অখাদ্য চাল, গরিবের ভাগ্যে ক্ষোভ

  মোঃ সাকিবুল ইসলাম স্বাধীন ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ , ৯:৫০:১১ প্রিন্ট সংস্করণ

নিজস্ব প্রতিবেদক: খাদ্য বান্ধব কর্মসূচির আওতায় ইউনিয়ন পর্যায়ে ১৫ টাকা কেজি দরে বিক্রিত সিদ্ধ চালের মান নিয়ে তীব্র প্রশ্ন উঠেছে। নিম্নমানের চাল মজুত থাকার অভিযোগে রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী এলএসডি রেলবাজার খাদ্য গুদামে সরজমিন গিয়ে দেখা যায় ভয়াবহ চিত্র। চালের মধ্যে খুদ, বড় ভাঙা দানা, চালের গুড়া, অর্ধসিদ্ধ দানা, মরা দানা, বিবর্ণ দানা, ভিন্ন জাতের চালের মিশ্রণ এমনকি দুর্গন্ধও পাওয়া গেছে। স্থানীয়রা বলছেন, গরিবের জন্য বরাদ্দকৃত চাল যেন অখাদ্য চালেই পরিণত হয়েছে।

 

সরকারি নির্দেশনায় চালের আর্দ্রতা ১৪%, বড় ভাঙা দানা ৬%, ছোট ভাঙা দানা ২%, ভিন্ন জাতের মিশ্রণ ৮%, বিনষ্ট দানা ০.৫% এবং খুদিময় দানা শূন্য থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে তার অর্ধেকেরও বেশি ক্ষেত্রে অনিয়ম পাওয়া গেছে। বিশেষ করে খুদ ও ভাঙা দানা নির্দেশনার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। অথচ চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোর (কামাল অটো রাইস মিল, হাসেম অটো রাইস মিল ও আজিজ অটো রাইস মিল) দায়িত্ব ছিল মানসম্মত চাল সরবরাহ করা।

 

এমন পরিস্থিতিতে সাংবাদিকরা গুদামে প্রবেশ করতে চাইলে জেলা প্রশাসকের অনুমতি ছাড়া চাল দেখানো যাবে না বলে জানান উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ আলী। তিনি আরও শর্ত দেন, একজন সাংবাদিক গুদামে ঢুকতে পারলেও ভিডিও ধারণে কড়া নিষেধাজ্ঞা থাকবে। এলএসডি’র ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নাজমুল আলমও বিভিন্ন নিয়মকানুন দেখিয়ে সময়ক্ষেপণ করেন। ঠিক সেই সময়েই অন্য কর্মকর্তারা গোপনে চাল সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে থাকেন।

 

কিছুক্ষণ পর দেখা যায়, গুদাম থেকে ট্রলি, ট্রাক ও ট্রাক্টরে করে চাল বাইরে সরানো হচ্ছে। নিরাপত্তা প্রহরী মনিরুজ্জামানও বিষয়টি স্বীকার করে জানান, ইতোমধ্যে একাধিক ট্রাক চাল বাইরে পাঠানো হয়েছে এবং আরও সরানোর প্রস্তুতি চলছে।

 

অন্যদিকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফয়সাল আহমেদ দাবি করেন, গুদাম ইন্সপেকশনে ভালো চাল পাওয়া গেছে এবং সে অনুযায়ী রিপোর্টও দেওয়া হয়েছে। তবে সাংবাদিকরা যখন চালের নমুনা সংগ্রহ করতে যান তখন প্রথমে বাধা দেওয়া হলেও পরে অনুমতি দেওয়া হয়। পরীক্ষায় নমুনায় ১৩.৮% আর্দ্রতা পাওয়া গেলেও ভাঙা দানা, খুদ ও মরা দানা নিয়ে কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।

 

গোদাগাড়ী উপজেলায় মোট ২৫ জন ডিলারের মাধ্যমে এই চাল কার্ডধারী গরিব মানুষদের মধ্যে বিতরণ হচ্ছে। শুধু খাদ্য বান্ধব কর্মসূচিই নয়, টিআর, টিসিবি, ভিজিএফ, ভিজিবি ও ভিজিডি প্রকল্পেও একই নিম্নমানের চাল সরবরাহ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এতে হতাশ ও ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ বলছেন, গরিবের মুখের ভাতেও অনিয়মের থাবা পড়েছে। চাল নিতে আসা এক কার্ডধারী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “১৫ টাকা কেজি দিলেও যে চাল পাচ্ছি, তা দিয়ে পরিবারের খাবার বানানোই কষ্টকর। গরিবের কষ্টের টাকা দিয়েও মানসম্মত খাদ্য জুটছে না—এটা সরকারের জন্যও লজ্জাজনক।”

 

স্থানীয়রা মনে করছেন, প্রশাসনের অবহেলা ও প্রভাবশালী মহলের ছত্রচ্ছায়া ছাড়া এ ধরনের নিম্নমানের চাল সরবরাহ সম্ভব নয়। সচেতন মহলের মতে, নিয়মিত নজরদারি ও কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা না থাকলে ভবিষ্যতে এ ধরনের অনিয়ম আরও বাড়বে। শুধু কর্মকর্তাদের রিপোর্ট নয়, স্বতন্ত্র তদারকি কমিটির মাধ্যমে চালের মান পরীক্ষা করার দাবি জানাচ্ছেন তারা। সমাজকর্মীরাও বলছেন, যেখানে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে গরিব মানুষ তিনবেলা খাবার জোটাতে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে নিম্নমানের চাল দেওয়া মানে তাদের সঙ্গে সরাসরি প্রতারণা। এটি মানবাধিকারেরও চরম লঙ্ঘন।

 

স্থানীয়দের অভিযোগ, সরকারি বরাদ্দের চালের মান যাচাইয়ে প্রশাসনের গাফিলতি থাকলে এ অনিয়ম চলতেই থাকবে। তাই দ্রুত কার্যকর তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ভবিষ্যতে চালের গুণগত মান নিশ্চিতে স্বচ্ছ প্রক্রিয়া চালুর দাবি তুলেছেন তারা।

আরও খবর

Sponsered content